শিশুকে সমাজের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা পরিবারের অন্যতম একটি কাজ। জন্ম গ্রহণের পর শিশুর সাথে পরিবারের একটি সম্পর্ক গড়ে উঠে। ৭/৮ মাস বয়সের মধ্যে শিশুরা মা-বাবা কিংবা যারা তাদের যত্ন নেয় তাদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে। এ বয়সের কোনো শিশুকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তারা তাদের মা- বাবার মনোযোগ পাওয়ার জন্য বিশেষ চেষ্টা করে। যখন মা শিশুর ঘরে প্রবেশ করে তখন শিশু খুশি হয়ে উঠে। মা তাকে কোলে তুলে নিলে সে তার মুখে হাত দেয়, চুল নাড়াচাড়া করে। শিশু ভয় পেলে মায়ের কোলে আশ্রয় নেয়। জন্মগ্রহণের পরপরই শিশুর সাথে মায়ের সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে। মায়ের কোমল স্পর্শ, স্নেহ, হাসি, ভালোবাসা সবই শিশুর সাথে তার গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলে।
গবেষকরা দেখেছেন বাবার সাথে শিশুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক শিশুর ইতিবাচক বিকাশে ভুমিকা রাখে। শিশুর লালন- পালনে বাবার অংশগ্রহণ মায়ের তুলনায় কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং কখনো কখনো শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও আবেগীয় বিকাশে মায়ের চেয়েও বেশি শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। যে পরিবারে বাবা শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দেন, শিশু লালন পালনে স্নেহপূর্ণ অংশ নেন সে পরিবারের শিশুর মধ্যে বিভিন্ন আচরণগত সমস্যা কম দেখা যায়। এমনকি বাবার অংশগ্রহণ, শিশুর কৈশোরের মাদকাসক্তি বা অপরাধমূলক কাজ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
শুধুমাত্র সন্তানের সাথে মা-বাবার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করলেই হবে না, মা-বাবার নিজেদের মধ্যেও স্বামী- স্ত্রী হিসাবে সম্পর্ক সুখের হতে হবে। কারণ সুখী মা-বাবার সন্তানেরাও সুখী থাকে। মা-বাবার সান্নিধ্যে শিশুরা অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করে এবং আনন্দ পায়। তাই মা-বাবার মধ্যে যখন সুসম্পর্কের অভাব থাকে তখন শিশু প্রতিপালনে তাদের মনোযোগ থাকে না। ফলে শিশুটির বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি শিশুকে পর্যাপ্ত খাদ্য দেওয়া হলেও যদি তার যথাযথ পরিচর্যা না করা হয়, তবে পর্যাপ্ত ভালোবাসা, মনোযোগ, ও উদ্দীপনা পাওয়া অপর একটি শিশুর তুলনায় তার মস্তিষ্কের বিকাশ কম হয়
ভাই-বোনের সাথে পারস্পরিক শিথিল সম্পর্ক একটি শিশুর আত্মধারণাকে বিঘ্নিত করে। ভাই-বোন শিশুটিকে যেভাবে মূল্যায়ন করে অর্থাৎ ভালো বা মন্দ বলে, নিজের প্রতি শিশুটির সে ধারণাই প্রতিষ্ঠিত হয়। বড় ভাই বোনকে অনুসরণ করে শিশু ভালো বা খারাপ আচরণ শেখে। ভাই-বোনের সান্নিধ্যে শিশু নিরাপত্তা পায়। আবার ভবিষ্যৎ জীবনে দলগতভাবে মেলামেশার অভিজ্ঞতা অর্জন করে। মা-বাবার পাশাপাশি পরিবারে ভাই-বোনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের জন্য প্রয়োজন। পরিবারে ভাই-বোনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় থাকলে উভয়েরই সাহচর্যে তাদের সময় আনন্দময় হয়ে উঠে।
শিশুর ভাই বা বোন হিসেবে যে সব আচরণ শিশুর সাথে
ভালো সম্পর্ক তৈরি এবং শিশুর বিকাশে সহায়তা করে ছোট ভাই বা বোনের যত্নে সহযোগিতা করা
কোনো জিনিস ভাগাভাগি করা
পরস্পরকে সাহায্য করা
- তাদের সঙ্গ দেওয়া, খেলাধুলা করা সবাই মিলেমিশে থাকা
তাদের সাথে স্নেহের সম্পর্ক তৈরি করা
যে আচরণ পারিবারিক সম্পর্ক উন্নয়নে ক্ষতিকর হয়
এবং শিশুর বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে
ছোট ভাই বা বোনকে সঙ্গ বা সময় না দেওয়া
নিজের স্বার্থ বড় করে দেখা
ঈর্ষা করা
- ভাই-বোনের সাহচর্য এড়িয়ে চলা
ঝগড়া করা, মারামারি করা
অবহেলা করা, নিজেকে বড় মনে করা
আমাদের দেশে যৌথ পরিবার প্রথায় একটি পরিবারে আরও অনেক সদস্য থাকেন, যারা শিশুর লালন-পালনে বাবা-মাকে সহযোগিতা করে থাকেন। বিশেষ করে কর্মজীবী মায়ের ক্ষেত্রে শিশুর যত্নে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ভূমিকা থাকে অনেক বেশি। শিশুর প্রতি আত্মীয়স্বজনের মনোভাব এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়। যখন কেউ মনে করে যে শিশুটিকে শুধুমাত্র পাহারা দিয়ে রাখতে হবে। শিশুর কথা শোনা, তার সাথে খেলা করার প্রয়োজন নেই, সে ক্ষেত্রে শিশুর সাথে সেই সদস্যের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে না ।
পরিবারে ভাই-বোনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় থাকলে উভয়েরই সাহচর্যে তাদের সময় আনন্দময় হয়ে উঠে। পরিবারে দাদা-দাদি, নানা-নানি শিশুর সাথে গল্প করেন, শিশুদের তাদের নিজের জীবনের অনেক ঘটনা শোনান। তাঁরা শিশুর অসুবিধার কথা শোনেন, তা সমাধানের চেষ্টা করেন। শিশুকে আদর-ভালোবাসা দেন ৷ এভাবে শিশুর সাথে পরিবারের সকলের ভাব বিনিময় শিশুর প্রথম বছরগুলোর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর চারপাশের মানুষের সঙ্গে ভাববিনিময় ও পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে। শৈশবে যদি পরিবারের সদস্যদের সাথে সুসম্পর্কের ভিত্তি তৈরি হয় ভবিষ্যতেও শিশু তার মা-বাবা, ভাই- বোন, পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে বন্ধু হিসেবে ভাবতে শেখে ৷
কাজ ১ পরিবারের ভাই-বোনের সম্পর্ক উন্নয়নের কয়েকটি উপায় লেখ ।
কাজ ২ - পরিবারের আর্থিক সংকটে তোমার করণীয় বিষয়গুলো উল্লেখ কর ।
পারিবারিক বিপর্যয়-
প্রতিটি শিশুর জন্যই প্রয়োজন হয় পরিবারের যেখানে সে আদর, ভালোবাসা, নিরাপত্তা ও বিশ্বাস পায়, সুরক্ষিত থাকে এবং তার মৌলিক চাহিদাকে পূরণ করা হয়। পরিবার এমন একটি সংগঠন যেখানে স্বামী-স্ত্রী একসাথে অবস্থান করেন। শিশুকে লালন পালন এবং শিক্ষিত করে গড়ে তোলার দায়িত্ব থাকে পরিবারের উপর।
শিশু পরিবারে জন্ম নেয় এবং বড় হয়ে উপার্জন করতে শেখে। এই দীর্ঘ সময়ে পরিবার অনেক ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। পারিবারিক এই বিপর্যয়ের মধ্যে আছে- মা কিংবা বাবার অসুস্থতা, মৃত্যুজনিত শূন্যতা, মা-বাবার পৃথক অবস্থান কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদ। এ ছাড়াও আছে বাবা-মায়ের সার্বক্ষণিক ঝগড়া, মতের অমিল, পরস্পরের সমঝোতার অভাব, পরিবারে বাবার অনুপস্থিতি বা চাকরি চলে যাওয়া, ব্যবসায় ক্ষতি, মায়ের উপর দৈহিক নির্যাতন ইত্যাদি। পারিবারিক বিপর্যয় যে ধরনেরই হোক না কেন, তা পরিবারের সদস্যদের কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। এতে শিশু জীবনের স্বাভাবিক বিকাশ বিঘ্নিত হয়।
বাবা/মায়ের মৃত্যু— পরিবারে বাবা কিংবা মায়ের মৃত্যুতে পরিবারে শিশুর জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। সাধারণত পরিবারে বাবা উপার্জন করেন। এ কারণে বাবার মৃত্যুতে পরিবারে আর্থিক সংকট প্রকট হয়। পরিবারে বিভিন্ন বয়সের শিশু থাকলে তাদের ভরন-পোষণ, লেখাপড়ার খরচ বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। মায়ের মৃত্যুতে সন্তানেরা দিশেহারা হয়। তাদের দেখাশোনা, যত্ন পরিচর্যায় অবহেলা হয়। বাবা কিংবা মা যে কোনো একজনের মৃত্যুতেই সন্তান স্নেহবঞ্চিত হয় ।
বাবা/মায়ের গুরুতর অসুস্থতা- পরিবারে মা বা বাবার হঠাৎ কোনো গুরুতর অসুস্থতা ধরা পড়লে পরিবারের উপর বিপর্যয় নেমে আসে। মা কিংবা বাবার দীর্ঘ দিনের অসুস্থতা পরিবারে সংকট সৃষ্টি করে। হঠাৎ কোনো গুরুতর অসুস্থতায় বা দীর্ঘদিনের অসুস্থতায় পরিবারে আর্থিক সংকট দেখা দেয়। এ ছাড়া মা-বাবার সুস্থ সঙ্গ থেকে শিশুরা বঞ্চিত হয়। মা-বাবার অসুস্থতায় তারা মা-বাবাকে হারানোর ভয়ে ভীত, হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মা-বাবা ছাড়াও পরিবারের যে কোনো সদস্যের গুরুতর অসুস্থতা পারিবারিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে।
পরিবারে ভাঙ্গন- স্বামী- স্ত্রীর মতের অমিল, পরস্পরের সমঝোতার অভাব, দ্বিতীয় বিয়ে ইত্যাদি পারিবারিক ভাঙ্গনের অন্যতম কারণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সন্তানেরা ছোট অবস্থায় পারিবারে ভাঙ্গনের আশঙ্কা বেশি থাকে। মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ বা পৃথকভাবে অবস্থান ছেলে-মেয়েদের মনে হতাশা, দ্বন্দ, পড়াশোনায় মনোযোগের অভাব প্রভৃতি মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। পরিবারে ছোট শিশু থাকলে তাকে যদি বাবার কাছে থাকতে হয় তবে মায়ের স্নেহ বঞ্চিত হয়ে তার বিকাশে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। একটু বড় শিশুদের ক্ষেত্রে পরিবারের ভাঙ্গনে তারা হীনম্মন্যতায় ভোগে। স্কুলগামী শিশুরা বন্ধুবান্ধবদের বিরূপ মন্তব্যে মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। অনেক সময়ে বিভিন্ন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যাতে পড়তে না হয় সেজন্য সন্তানেরা কোথাও বের হতে চায় না, সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করে দেয়, তারা অন্তর্মুখী হয়। তাদের মনের কষ্ট অনেক সময় শারীরিক কষ্টে রূপ নিতে পারে। যেমন- মাথাব্যথা, খাবারে অনীহা, ঘুমের ব্যঘাত ইত্যাদি ৷
পারিবারিক বিপর্যয়ে পরিবারের সদস্যরা একত্র হয়ে সংকট মোকাবিলা করলে সমস্যা অনেক কমে যায়। পারিবারিক বিপর্যয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হয় আর্থিক সংকট। পরিবারের আর্থিক সমস্যা
দূর করতে এবং ছোট শিশুদের বিকাশজনিত চাহিদা পূরণে পরিবারের কিশোর বয়সের সন্তানেরা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিতে পারে। তারা যা যা করতে পারে –
কাজ- তোমার জানা কোনো পরিবারের যে কোনো বিপর্যয়ে তারা যে ধরনের সমস্যার সন্মুখীন হয়েছে— তা লেখ। ওই পরিবারটির সহায়তায় তোমার করণীয় কী তা উল্লেখ কর ।
Read more